যারা এখনো শুধুই বন্ধু, বন্ধুর চেয়ে বেশী হয়েও অন্ধ, কিংবা জানালার একটা পাল্লা বন্ধ, একটু ভাল আর একটু মন্দ

তাদের জন্যেই কিছু এবড়ো খেবড়ো ছন্দ, তাদের জন্য কবিতা-গল্প, অল্প স্বল্প প্রেম, আড্ডা, হঠাৎ মেঘ এবং বৃষ্টি।

শৈশবের স্মৃতি থেকেঃ ৬

আমি তখন খুব ছোট। খুব ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যপট মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। মায়ের পুরোনো স্কেলচেঞ্জার হারমোনিয়ামটা বাক্স থেকে টেনে বের করে এক অদ্ভুত ভালোবাসা নিয়ে বুধবার বিকেলে মা বসতো গান করার জন্য। ওই বিশাল হারমোনিয়ামটার এগারো ঘাটের চেঞ্জার। অনেকক্ষণ সরগম করার পরে হঠাতই হলুদ ডায়েরির পাতা থেকে গেয়ে উঠতো এক একটা গান। অযত্নে বসে যাওয়া অথচ সুরেলা গলা দিয়ে অঝোরে বেরিয়ে আসা স্বরগুলোতে ঘরটায় একটা প্রাণ আসতো। স্কুলের হোমটাস্ক, রান্না ঘরের কাজ, সব সরিয়ে মেতে উঠতো ঘরটা। তিন খন্ডের গীতবিতান নিয়ে একের পর এক পাতা উলটে গেয়ে চলা হতো। স্বরলিপি না পেলে সা-পা ধরে গলা মেলানো হতো। বার বার পিছলে যাওয়া সুরগুলোকে।

মা’র খুব প্রিয় গান ছিল ‘রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে’। গীতবিতানের পাতা উলটে ওখানে এসেই থেমে যেতো। অনভ্যাসের গলা থেকে বেরিয়ে আসা বোধটুকুতে পূর্ণ থাকতো এক একটা শব্দোচ্চারণ। পূজো করার মত, মন্ত্র বলার মত করে শব্দগুলো ঘুরে ফিরে যায় এদিক ওদিক। ঘরটা ভরে উঠতো সিকিমের কোন এক দূর গ্রামের ভিতরে লুকিয়ে থাকা মনাস্ট্রির দেওয়ালে আছড়ে পরা বৌদ্ধবাণীর মত এক অদ্ভুত দেবভাষায়।

কোন এক আরব্যরজনীতে মা গল্প বলেছিল, মালকোষ রাগ নাকি জীনদের খুব প্রিয়। গাইলে তারা সারি দিয়ে বসে মন দিয়ে শোনে, আর যে গাইছে তাকে প্রভু বলে মানে। আমারও অবস্থা ঐ জীনদের মতই ছিল। এক এক গভীর ঘুম না আসা রাতে মায়ের গলা শুনে আমার ঘুমিয়ে যেতাম।একা একা বারান্দায় বসে অনেক দূর আকাশের আর্দ্রা নক্ষত্রের দিকে চেয়ে গেয়ে চলা ‘চেয়ে থাকি যে শূন্যে অন্যমনে সেথায় বিরহিণীর অশ্রু হরণ করেছে ওই তারা’।


তারপর আস্তে আস্তে বড় হয়েছি। সেই গানগুলো এখন পালটে গেছে। সেই জায়গাগুলো নিয়ে  নিয়েছে মোজার্ট, বাখ, চাইকোভ্স্কি, হ্যান্ডেল, ভিভালডি, মাহ্লার, লিওনার্ড কোহেন, হ্যারি বেলাফন্টে, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পিঙ্ক ফ্লয়েড, মেটালিকা, লিঙ্কিন পার্ক, গ্রিন ডে, জন ডেনভার, এলভিস প্রিসলি, বিট্ল্স্ এর দল। আমি এখন ভেসে চলি এদেরই সাথে অতলান্তিকের ঢেউরাশির উপর, সপ্তক থেকে সপ্তকে।

No comments: