প্রথম না বলা অনেক কথাই কবিতা হয়না, নীরব জলছাপ থেকে অবশ্যই
গোপনে আমরা সবাই কবি,
লিখিনা হয়তো অনেকেই।
লেখালেখি জিনিসটা আমার দ্বারা হবেনা। এটা কেউ পরিস্কার করে না বললেও হাবে-ভাবে বুঝিয়ে দেয়।
কিন্তু আমার এই রসাভাব সত্ত্বেও বেশ কিছু কবি বন্ধু জুটে গেছে নানা সময়। এবং
তাদের কবিতার ল্যাজা মুড়ো না বুঝে পেলেও বাকিদের পিঠ চাপড়ানি দেখে আন্দাজ করে
নিয়েছি যে তারা ভালো লেখে। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে যে কবিতার প্রতি আমার এরকম
নির্দয় বিতৃষ্ণার কারণ কি,
তাহলে একটা গল্প বলতে হয়। অবশ্যই সব কবি এবং কবিতাই যে
আমার নির্বোধের শিকার,
তা নয়। Exceptions prove the law.
ইস্কুলের শেষ ভাগ থেকে আমার একটু কবিতা লেখার ইচ্ছে হয়েছিল। আসলে ওই প্রেমে
পড়লে বা ব্যর্থ হলে কবিতা লেখার যে ব্যাপারটা আসে, সেরকমই আর কি। রাত বিরেতে অঙ্ক খাতার পিছনে ইন্টিগ্রেশনের ফাঁকে লিখে ফেলা দুই
এক লাইনের বেশি তা আর এগোয়নি। কবিতার বই কিনেছি দু-একটা। পড়ার চেষ্টাও করেছি।
লোকের কাছ থেকে আর লম্বুর (শুভদ্বীপ দেব) কাছ থেকে বই ধার করে এনে পড়েছি। সেই বই
গুলো ফেরত দেওয়া হয়নি। এই 'ধার করা' আর 'বই ফেরত দেওয়ার' কথায় একটা গল্প মনে পড়ল।
গল্পটা মার্ক টোয়েইনকে নিয়ে। মার্কের ঘরে অনেক বই ছিল। কিন্তু সাংঘাতিক
অগোছালো। একদিন এক বন্ধু এসে মার্ককে বলল, ভাই,
তুমি একটা আলমারিতে বই গুলো সাজিয়ে রাখলে পারো তো। দেখতে
ভালো লাগে। টোয়েইন তখন গম্ভীর ভাবে বললেন, দেখো ভাই,
বইগুলো যেভাবে জোগাড় করেছি, আলমারি তো আর সেভাবে জোগাড় করা যায়না।
গল্পের সার্থকতা এই যে,
ভদ্রলোকের কিছু গুণ আমার মধ্যে ছিল। সুবিধের মধ্যে এই যে
একটা আলমারি ছিল,
তাই টোয়েইনের মত দশা হয়নি আমার। এই সব কবিতার বই-টই পড়ে
আমার কবিতা লেখার একটা ঝোঁক চেপেছিল।
সেসময় আমার এক বন্ধু শুভদ্বীপ এক নাগাড়ে কবিতা লিখতো এবং নানা কবি সভায়
কবিতা পড়ে বেশ বাহবা পেত বলে শুনতাম। পরে যদিও তার কাছ থেকে বিনয় মজুমদারের
কয়েকটা বই আবিষ্কার করেছিলাম। সে কবির
কবিতার এক অত্যাশ্চর্য ‘প্রতিফলন’ পেয়েছিলাম তার
কবিতায়। যাক গে,
তার কথায় দাঁড়ি টানি।
আমার মেজ মাসিও ভালো কবিতা লেখে। একদিন হঠাৎ ফোন করে বলল, আগরতলায় একটা কবি সম্মেলন আছে, যাবি? ‘এক গাল মাছি’ হয়ে কিছুক্ষণ থেকে তারপর বলি, যাব। মাসি বলল, একটা কবিতা নিয়ে যাস। পড়বি। আমার মাথায় বজ্রাঘাত। কবিতা কোথায় পাব? শেষ-মেষ একটা বুদ্ধি চাগাড় দিল। একটা কবিতা তৈরী হল একটা
উপায়ে। বলতে নেই,
একেবারে অত্যন্ত আধুনিক কবিতা।
অতঃপর বিকেল বেলা। ন্যাপথলিনের গন্ধওয়ালা একটা পাঞ্জাবি গায়ে চললাম কবি
সম্মেলন দেখতে। হাতে একটা খাতা। তার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে আমার আনকোরা হাতের লেখায়
কয়েকটি কবিতা। সম্মেলনটি যাঁর
বাড়িতে হয়েছিল,
তাঁর সাথে আমার এখনো ফেসবুকে যোগাযোগ আছে। তাই তাঁর নামে
কিছু বলে আর ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টের দৈর্ঘ হ্রাস করতে চাইনা। সম্মেলনের কথাই বলি।
কবি সম্মেলন সম্পর্কে সেরকম সম্যক কোন ধারণা আমার কাছে ছিলনা। গিয়ে দেখি, গোটা কয়েকজন কবি খাতা হাতে হাজির। মধ্য, পূর্ণ এবং অপূর্ণ (আমি) বয়স্ক – সবরকম কবিই আছেন তার মধ্যে। গুটি গুটি এক কোণে বসে পড়ি।
কবিতা পড়া শুরু হল এক এক করে। এক একজন কবিতা পড়েন, বাকিরা সবাই মিলে আহা-উহু করে। কাব্য রস, ভাব ইত্যাদি কঠিন বিষয় নিয়ে নিদারুণ বিশ্লেষণ। এর মধ্যে এক ব্যক্তি ছিলেন।
ভদ্রলোকের হাব-ভাব এবং বাকিদের সম্মান প্রদর্শন ইত্যাদি দেখে মনে হচ্ছিল যে উনি
বেশ কেউকেটা। নাকের আগার চশমার কাঁচের ধুলো পরিষ্কার করতে করতে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কবে চানাচুর খেয়েছিলেন, সেই গল্প শোনালেন। ভদ্রলোকের প্রতিভা স্বীকার না করে উপায় নেই। নাহলে নিতান্ত
চানাচুর খাওয়ার মত জিনিস (সে যার সঙ্গেই হোক, সুনীল বা প্রিন্স অফ ওয়েলস্) এমন ফেনিয়ে বলা যায়, আগে জানতাম না।
একসময় আমার কবিতা পড়ার ডাক পড়ল। আমায় করা সম্ভাষণ থেকে আমার কাব্য প্রতিভা
সম্পর্কে নানারকম দ্যুতি বিচ্ছুরিত হল। ভয়ে ভয়ে খাতা বের করে পড়ে ফেললাম।
কবিতাটা এরকম ছিল,
তুমি আমার গোধূলি বেলা, বৃষ্টি ভেজা কাক
সন্ধ্যে হলেই ভেস্তে যাও, রাত্রি বলে থাক।
গভীর রাতে নিয়ন আলো, ঝিলের ধারে কই,
সন্ধ্যে আলো বর্ষা ভালো তোমার সাথে সই।
রাত-বিরেতে বৃষ্টি বাদল, কফির কাপে সুখ,
মেঘের পরে মেঘবালিকা, ঠোঁটের পরে মুখ।
কবিতা পড়া শেষ হয়ে ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে তাকাই। সমালোচকের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তবে সবাই যে নির্দয় তা নয়। বাকিদের সম্পর্কে ধারণা না থাকলেও আমার নিজের কবিতা
সম্পর্কে এবং তার ওরিজিন সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল। তাই প্রথমে ভয়ে, তারপর অবাক হয়ে এবং সব শেষে হাসি চাপতে হল। আমার কবিতার
মধ্যে যে অদ্ভুত শব্দচয়ন তা তাঁদের মুগ্ধ করেছে। একজন তো বলেই ফেললেন, আধুনিক কাব্যে এরকম শব্দসজ্জা এবং তার আলঙ্কারিক প্রয়োগ
অভুতপূর্ব। আমার কবিতার মধ্যে নারী ও নরের মধ্যের বাহ্যিক ও আন্তরিক সম্পর্কের ঠিক
যে ভাবটা প্রকাশ পেয়েছে,
তাও নাকি এক অসামান্যতার দাবী রাখে। কিন্তু ভাবটা যে ঠিক কি
সেটা কেউ বললেন না।
সম্মেলন শেষে মাসিকে নিয়ে রাস্তায়। মাসি এতদিন হাজার কবিতা লিখেও প্রথম দিনে
এত খ্যাতি পায়নি। ঈর্ষান্বিত মুখে
প্রশ্ন করল,
এরকম লিখলি কি করে? আমি বললাম,
লেখা নয়, একে বলে
ম্যানুফ্যাকচার করা। মাসি বলল- মানে?
একটু হেসে বলি,
খুব সিম্পল। কয়েকটা ম্যাগাজিন ছিল ঘরে। এক একটা লাইন এক
একটা কবিতা থেকে নিয়ে জাস্ট বসিয়ে দিয়েছি। শুধু অর্গানাইজ টা করতে হয়েছে।
No comments: