ছোটবেলায় কোনও একদিন বাবাকে রাতে খেতে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
আচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, জগদীশ বসু, এরকম বিখ্যাত মানুষ এখন কে আছে?
নেহাতই ছেলে মানুষী প্রশ্ন। আমার বয়স তখন ছয় কি সাত।
সত্যজিৎ রায় মারা গেছেন কয়েকবছর আগে। বাবা উত্তর দিয়েছিল সুনীল গাঙ্গুলি।
আমাদের বাড়িতে পুরোনো পত্র পত্রিকার জন্য দুটো বড় বাক্স
বরাদ্দ ছিল। তার নিচের দিকে থাকতো পুরনো পূজাবার্ষিকী। আমি মাঝে মধ্যেই আরশোলা
তাড়িয়ে টেনেটুনে এক একটা আনন্দমেলা বের করে আনতাম। একলা দুপুরের সঙ্গী করার জন্য।
মা একটু ঘুমিয়ে নিতো আজকের দুপুরগুলোতে। আর ঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে বুক পেতে শুয়ে পাতা
উল্টাতাম পুরনো ছাপা ভ্যাঁপসা গন্ধ মাখা আনন্দমেলার। কাকাবাবু তখন অনেকখানি
আকর্ষণের জায়গা।
“মিশর রহস্য”, “আগুনপাখির রহস্য” এর মত সব উপন্যাস কোন ফাঁকে বিকেল ঘনাতো
বুঝতেই পারতাম না। এরকম একগাদা রোমাঞ্চ নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাকাবাবুর
বাড়ি কোথায়? বাবা বলেছিল কাকাবাবু বলে কেউ নেই। এসব সব মিথ্যে। একটুকুও বিশ্বাস হয়নি তখন।
বড় হওয়ার সাথে এই অবিশ্বাসগুলো বিশ্বাস হয়। তবু আনন্দমেলা কেনা বন্ধ হয়না। হাতে
নিয়েই পাতা উল্টে চলে যায় কাকাবাবুর পাতায়।
জানি সেই মান আর নেই। সবুজ দ্বীপ কিম্বা পাহাড় চূড়ার সেই
গায়ের লোম খাঁড়া করে দেওয়া উত্তেজনা ফিকে হয়ে গেছে অনেকখানি। তবু ছেলেবেলা থেকে
গায়ে মেখে বড় হওয়া চরিত্রগুলোর মায়া ছাড়া সহজ নয়। কে জানতো মায়া ছাড়তেই হয় যখন কলম
আর কথা বলেনা। যখন কাকাবাবুর চোখে নেমে আসে ঘুম। জীব আর জড়ের বিভাজিকায় দাঁড়িয়ে
বাকস্তব্ধ হৃদপিণ্ড এক গভীর নিরবতাকে সঙ্গী করে ছন্দপাত ঘটায় প্রাণছন্দের। কোনও
আনমনে শুরু হওয়া লেখা সাহিত্য হতে গিয়ে থমকে যায়, অথবা অভ্যাসে লিখে চলা এক কাকাবাবুর কথা হয়ে যায় তার শেষ
অভিযান।
No comments: