কালিপুজোর পরে, যখন ঠিক বার্ষিক পরীক্ষাটাও আসবে আসবে করছে, বাবা অফিস থেকে ফিরলেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে তার মধ্যে আতি-পাঁতি করে খুঁজে দেখতাম কোনো মোটা বই উঁকি মারছে কিনা। অন্য সময় কখনো বেরিয়ে আসতো সারলক হোমস, একটা গোটা ফেলুদা বা কিশোরভারতী। তখন হাতে নিয়ে বসে পড়তাম। অন্তত কিছুটা উলটে দেখা চাই। মা-এর
বকুনিকে শেষমেশ পাত্তা দিয়ে প্রচন্ড অনিচ্ছায় খেয়ে উঠে আবার পড়ব বলে, পড়ার বই হাতে নিতাম। কিন্তু এই পুজোর
পরে কিশোর ভারতী আর খুশি করতে পারতো না। খালি মনে হত
কবে আসবে নতুন আনন্দমেলা।
আমি কোনোদিন শুকতারা বা চাঁদমামা এসব পড়িনি। ছোটদের ম্যাগাজিন মানেই বুঝতাম প্রায় বন্ধ হয়ে আসা সন্দেশ, কিশোর ভারতী কিংবা আনন্দমেলা। আনন্দমেলার রং-চঙ্গে মলাটে সুন্দর সুন্দর লেখা আমায় সবচেয়ে বেশী টানত। আর পুজোর আনন্দমেলা হলে তো কথাই নেই। সেই যবে থেকে আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপণ বেরোতো ‘শীঘ্রই প্রকাশিত হবে’ বলে, সেদিন থেকে ‘প্রকাশিত হল’
অব্ধি সময় যেন কাটতেই চাইত না। বিজ্ঞাপনে দেওয়া উপন্যাস গুলোর ‘টিজার’ পড়ে
পড়ে প্রায় মুখস্থ করে ফেলতাম। আর ঠিক যবে বাবার
ব্যাগ থেকে খুঁজে পেতাম, মায়ের
হাজার বকুনি সত্ত্বেও সেদিনকার মতো পড়ার বই এর সাথে সম্পর্ক শেষ।
পুজোর ঠিক আগে আগে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা থাকত। বাবা বলত ‘এনে দিয়েছি, কিন্তু এখন পরীক্ষা দিয়ে নে, তারপর পুজোর মধ্যে পড়বি’। আমি নাছোড়। তখন বলত, ‘পড়া হয়ে গেলেই তো শেষ। তখন দেখবি বন্ধুরা
সবাই পড়ছে, আর তোর পড়া হয়ে
গেছে’। কিন্তু আমি পরীক্ষার দিন গুলোতেও
সকালে রিভাইস করে, তারপর
একটা গল্প পড়ে নিয়ে পরীক্ষা দিতে যেতাম। নিজেকে বোঝাতাম, একটা গল্প পড়লে যদি সব ভুলে যাই, তাহলে
ভুলে যাওয়াই ভালো। আর সুন্দর একটা
গল্প পড়ার পর এই ‘ফিল
গুড’ মনটা নিয়ে পরীক্ষা গুলো কিন্তু দিব্যি ভালো হতো।
সেবার কোনো এক বছর, বাবা আমার জন্য আনন্দমেলা আনল না। কেন আনল না সেটা আমার মনে নেই। সেবার কাকাবাবুর সেই আরাকু ভ্যালিতে অভিযান নিয়ে একটা গল্প
বেরিয়েছিল। সেবার আমার আনন্দমেলা পড়া হয়নি, দুঃখটা এত হয়েছিল যে এখনও এই অ্যাত্ত বড় বয়স
অব্ধিও জ্বলজ্বলে মনে আছে। আর খুব ছোটবেলায়
আর একটা আনন্দমেলার কথা খুব মনে পড়ে। তখন নিজে নিজে
গড়গড় করে পড়ার বয়স হয়নি। ফাঁক পেলেই বানান
করে করে পড়ার চেষ্টা করে যেতাম। সেই আনন্দমেলাটায়
শীর্ষেন্দু-র ‘নবীগঞ্জের দৈত্য’ বেরিয়েছিল। আর ছিল কাকাবাবুর ‘আগুন-পাখির রহস্য। কিকিরার ‘হলুদ পালক বাঁধা তীর’। একটু বড় হয়ে
আমি আমাদের পুরোনো পত্রিকা রাখার বাক্সে অনেক খুঁজেছি সেটা। কিন্তু আরো পুরনো আনন্দমেলা পেয়েছি, সেটা যে কোথায় উধাও হয়ে গেছিল, কোনোদিন পাইনি। মাঝে মাঝে মনে
হত, ওই আনন্দমেলা-টা যেন ইচ্ছে
করেই গা ঢাকা দিয়েছিল। যেন, আমায় বোঝাতে চেয়েছিল, ‘বানান করে পড়ে যে আনন্দটা পেয়েছিলে, সেটাকে যত্ন করো,
রেখে দাও সাজিয়ে। মন নিয়ে যদি
আবার আমায় গড়গড়িয়ে পড়তে থাকো, বিশ্বাস করো, আমি তোমার মনের ওই ভালোলাগাটা
জুড়ে থাকতে পারবনা’। সেটাই হয়ত সত্যি। ওই “নবীগঞ্জের
দৈত্য’’, বা “আগুন-পাখির রহস্য’’ বই হয়ে বেরোনোর পর পড়েছি অনেকবার,
কিন্তু আমার মনের ছেলেবেলায় সেই চিলেকোঠার গুপ্তধনের মতোই থেকে গেছে
অসম্ভব ভালোলাগা সেই না-পাওয়া আনন্দমেলাটা।
No comments: