যারা এখনো শুধুই বন্ধু, বন্ধুর চেয়ে বেশী হয়েও অন্ধ, কিংবা জানালার একটা পাল্লা বন্ধ, একটু ভাল আর একটু মন্দ

তাদের জন্যেই কিছু এবড়ো খেবড়ো ছন্দ, তাদের জন্য কবিতা-গল্প, অল্প স্বল্প প্রেম, আড্ডা, হঠাৎ মেঘ এবং বৃষ্টি।

শৈশবের স্মৃতি থেকেঃ ১

ছোটবেলায় নাটক করার খুব সখ ছিল। আড়াই বছর বয়সে খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনদিয়ে আমার প্রথম নাটকে পা ফেলা। নাটকটি হয়েছিল কৈলাসহর সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের মঞ্চে। ছোটবেলার খোকাবাবুপাওয়া যাচ্ছিল না বলে প্রদ্যুত কাকু আমাকেই খোকাবাবু বানিয়ে দিয়েছিল। আমার শুধু দুটো ডায়লগ ছিল। চন্দ্র ফুঁতখন ফুল বলতে পারতাম না। মুন দিদি, বিন্তী দিদি, তন্দ্রা দিদি তখন অনেক ছোট ছিল এইট নাইনে। শাড়ি ও পড়তো না বোধহয়। 

আশ্রমে প্রতি বছর দুর্গাপূজা কালীপূজা ও নানা অনুষ্ঠানে নাটক হতো। দায়িত্বে অরবিন্দ জেঠু। গান হতো, নাচ হতো। আবোল-তাবোল হতো অভিনয় করে। একবার নাটক হবে জটায়ু বধজেঠুই আমাদের রিহার্সাল করাতো। তাকে যে ডিরেক্টর বলে, সে জ্ঞান তখনও হয়নি। তবু তার কথা শুনে চলতে বেশ লাগতো। প্রথম দিন আমাদের সবাইকে ডাকা হল সদন ইস্কুলের বড় ঘরটায়। স্কুলটা এখন আর নেই। শেষ কবে ক্লাস হয়েছে মনে পড়ছে না। বরাবরের বেঁটে খাটো, রোগা চেহারার আমি। অরবিন্দ জেঠু ডেকে অন্যদিকে দাঁড়াতে বলল। তারপর অনমিত্র, কুন্তল, টুটন, মৌমিতা, নিচের ক্লাশের সুস্মিতা আরও কয়েকজন। জটায়ু বধএ আমি নাকি রাবণ হব, আর আবোল-তাবোলএ হুঁকোমুখো হ্যাংলা! বেশ মজা লাগলো। ততদিনে রামায়ণ শুনে শুনে আমার সব ঘটনা বলতে গেলে মুখস্থ। আর বইমেলা থেকে বাবা কিনে দিয়েছিল হলুদ মলাটের আবোল-তাবোল। নিউ স্ক্রিপ্টের। ওখানে হুঁকোমুখো হ্যাংলার দুটো ল্যাজওয়ালা চেহারাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। জোর কদমে চলতে লাগল রিহার্সাল। মৌমিতা সীতা হয়েছিল। নাটকটা জটায়ু বধএ সমাপ্ত হওয়াতে আমাকে বধ হতে হয়নি, তবে সীতাকে হরণ করার সৌভাগ্যটুকু হয়েছিল।

নাটকের দিন আশ্রমের পুরনো নাট মন্দিরে বিশাল স্টেজ হয়েছিল। স্পিরিট গাম দিয়ে লাগানো গোঁফ নিয়ে, সত্যিকারের তরোয়াল নিয়ে। এর আগে বাড়ীতে কাঠের তরোয়াল নিয়ে কত যে দস্যু হত্যা করেছি, রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। রাজার জমকালো ড্রেস সেফটিপিন দিয়ে আটকে নিজেকে রাবণ-ই মনে হল সত্যিকারের। অতঃপর জটায়ুর ডানা কেটে সীতাকে নিয়ে পগার পার। মাঝখানে শুধু কোমর থেকে একবার তরোয়াল খুলে পড়ে গেছিল জটায়ুর সাথে যুদ্ধ করার সময়। আমি স্মার্টলি জটায়ুরূপী কুন্তলকে বললাম, “দাঁড়া দেখছিস না, তরোয়াল পড়ে গেছে”, বলে তরোয়ালটা কুড়িয়ে ওর ডানা কেটে তবেই ওর মুক্তি দিলাম। 

এরপরেও স্কুলে ও কম্পিটিশনে অনেক নাটক করেছি। ক্লাশ ওয়ানে মিমদিদি, তৃষা ও দেবায়নের সঙ্গে জুতা আবিস্কার, ক্লাস টু তে তাপসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গেছো বাবা’, ক্লাস ত্রি তে আবিরদাদা, দেবায়ন, লম্বু, কুশল, শতাব্দী দিদি, সহেলী দিদি, সোহেনি দিদির সঙ্গে চিচিংগে এন্ড কোং”, ফোর এ ভ্যা ভ্যা”, ফাইভ এ ডাস্টবিন”, “একটি নতুন স্বপ্ন”, “সঞ্জীবনী,একধামা আলু”, “তোমারি গেহেআরও অসংখ্য নাটক, মনে আসছে না।

গরমের ছুটি যেদিন পড়ত, তার আগেরদিন। সে এক পণ্ডিতের গল্প। গল্পটা শুনেছিলাম কারোর কাছে। স্ক্রিপ্ট বানালাম আমিই। কুন্তল পণ্ডিত। আর আমি বাবু। মনে আছে, বেশ হাততালি পেয়েছিলাম। এরপর বৃত্রাসুর বধসেটাও বেশ মনে আছে। আমার একটা ছোট্ট নোটবুকে লিখেছিলাম নাটকটা। আমি ইন্দ্র হয়েছিলাম। বৃত্রাসুর কে হয়েছিল মনে নেই, মনেহয় অনমিত্র। কোনও এক বছর বইমেলা থেকে বাবা একটা বই কিনে দিয়েছিল। তারমধ্যে রবীন্দ্রনাথের একটা নাটক আছে। কিন্তু যে কারণেই হোক নাটকের শেষটা আমার পছন্দ হয়নি। তাই দিলাম কলম চালিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপর। নিজের মত করে সাজিয়ে নিলাম স্ক্রিপ্ট। জোর কদমে প্রতিদিন পূজার আগে চলতো রিহার্সেল। দেখতে দেখতে চলে এল সেই পূজা। লো বেঞ্চ খাড়া করে বানানো হল গাছ। তার ওপর সবুজ রঙ করা পিস্বোর্ড দিয়ে পাতা। তার পিছনে আমি।

এরকম নাটকগুলো আমার কাছ থেকে আজকাল অনেকটা দূরে সরে গেছে। সেইসব ক্ষুদে ক্ষুদে ডাইরির পাতায় লেখা বৃত্রাসুরেরস্ক্রিপ্ট, নির্ভয়ে কলম চালানো রবীন্দ্রনাথে, সব কেমন যেন দূরে সরে যায় বড় হওয়ার সাথে। জীবনের ব্যস্ততা যতই বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে তত নিজের বুদ্ধি ও বোধ। আর ততই নানারকম দার্শনিকতা বেড়িয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে একটা লাইন বাদ দেওয়ার আগে তার অর্থ বুঝতে হয়, গভীরতা অনুভব করতে হয়। নিশ্চিন্তে জটায়ুকে দাঁড় করিয়ে রেখে, যাওয়া যায়না তাকেই মারার জন্য তরোয়াল কুঁড়িয়ে আনতে।

No comments: