কবি জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ বাংলা সাহিত্যে একটি বহুল আলোচিত কবিতা। বহুল আলোচিত বলেই এর ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন বলে মনে করলাম। আসলে দীর্ঘদিন ধরেই কবিতাটিকে একইভাবে পড়ছি। আমরা কবিতাটি সম্পর্কে পূর্ব-ধারণা নিয়ে আবৃত্তি করি। যার ফলে কবিতাটি তার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমার এই বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য অবশ্যই জীবনানন্দ কে ছোট করা নয়, ধরে নিতে পারো অন্যান্য বকওয়াস্ গুলোর মত এটাও একটা।
বনলতা সেন কি নারী না পুরুষ কবিতটি পড়ে বুঝতে পারলাম না আজও। ”অন্ধকার বিদিশার নিশার মত চুল” এবং “শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মত মুখ এবং “পাখীর নীড়ের মত চোখ”নারী বা পুরুষ যে কারো থাকতে পারে। বরং দীঘল কেশ, কাজল-টানা চোখ এর কথা উল্লেখ থাকলে বনলতা সেন যে আসলেই একজন নারী তা নিশ্চিত হওয়া যেত। শুধু চুল, মুখ ও চোখের বর্ণনা নারী দেহের সৌন্দর্য বর্ণনার জন্য যথেষ্ট কি?
“বনলতা সেন” কবিতা জুড়ে একজন পর্যটকের বর্ণনা প্রাধান্য পেয়েছে নাকি একজন প্রেমিকের উচ্ছাস প্রাধান্য পেয়েছে?
বনলতা সেনের প্রতি কবির প্রেম কি একতরফা ?
বনলতা কি শুধুই সৌন্দর্যময়ী না প্রেমময়ী ?
জীবনানন্দের প্রতি বনলতা সেনের প্রকৃতই প্রেম নাকি একজন চরম হতাশাগ্রস্থ পুরুষের প্রতি সহানুভূতি?
তিনি বনলতা সেনকে কেন অন্ধকারে আকাঙ্খা করেন? বনলতা কি বিবাহিতা না কুমারী?
কবিকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলেন বনলতা সেন, এই শান্তি কি শুধুই মানসিক নাকি মনোদৈহিক?
নাটোরের বনলতা সেন কবিকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলেন, তবে তিনি আর কোথায় শান্তি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন?
নাটোরের বনলতা সেন এর সাথে উনার কি নাটোরেই দেখা হয়েছিল নাকি অন্য কোথাও?
তিনি যে সময়ের নাটোরের বনলতা সেন এর কথা বলেছেন সে সময়ে নাটোরে সেন বংশীয়া সম্ভ্রান্ত সুন্দরী রমণী বসবাস করতো বলে শুনিনি।
তিনি কি শুধুই ভ্রমণ-ক্লান্ত ছিলেন নাকি দেহে-মনে অতৃপ্ত ছিলেন?
বনলতার সাথে কবির এই মিলন দুটি অসমবয়সী নর-নারীর মিলন কিনা, কারণ দীর্ঘ পথচলার শেষে উনি বনলতা সেনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। আর সেজন্যই কি অসমবয়সী বনলতা উনাকে দু’দন্ড শান্তি দিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন?
জীবনানন্দ ছিলেন দাশ বংশীয় আর বনলতা ছিলেন সেন বংশীয়া- এ জন্যই কি বনলতা অসবর্ণ সম্পর্কে সম্মত হননি।
কবিকে বনলতা সেনের তির্যক প্রশ্ন – এতদিন কোথায় ছিলেন’?
বনলতা সেন কি উনাকে সন্দেহ করতেন?
“অন্ধকার বিদিশার নিশা” দ্বারা নিষ্প্রদীপ বিদিশা নগরীকে বোঝায় না। কাজেই ঘন-কালো চুলের উপমা হিসেবে এটা সঠিক নয়। আর অন্ধকারে বনলতার সাথে সাক্ষাৎ করে বনলতার সৌন্দর্য সম্পূর্ণ অবলোকন করা কি সম্ভব? আর অন্ধকারে কবির উপস্থিতি টের পেয়েও বনলতা কেন প্রদীপ জ্বালেননি? অন্ধকারের সাক্ষাৎ পর্বটি প্রচলিত নৈতিকতা-বিরোধী বলে মনে হয়।
“ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিল”–’রোদের রঙ’ এর জায়গায় ‘রোদের গন্ধ’ লেখার মত ভুল তথ্য কি উনার মত কবির কাছ থেকে আদৌ প্রত্যাশিত ?
তাছাড়া উনার চিন্তাধারায় যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান। হাজার বছর পথ হাঁটার কথা বলে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের বর্ণনা দিয়েছেন। আমার মনে হয় তিনি চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাহলে বলা উচিত ছিল–”হাজার বছর আমি জলে ভাসিতেছি পৃথিবীর জলে/সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে”।
আর মালয় সাগরের আদৌ কোনও ভৌগলিক অস্তিত্ব আছে বলে আমি ভূগোলে পাই নি। আর উনার ভৌগলিক বর্ণনা প্রাচীন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সীমিত — তাহলে এই বর্ণনা কিভাবে সকল দেশ কালের পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করে? এটি এশিয়াবাসী হতাশাগ্রস্থ পুরুষের নারীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
কবি মাত্র হাজার বছর পৃথিবীর পথে হেঁটেছেন– এ দ্বারা হাজার বছরের পুরুষের কথাই বলেছেন মনে হয়।
বনলতা সেন চরিত্রটি (সুন্দরী, অহংকারী, পুরুষবিদ্বেষী যিনি পুরুষকে দুদন্ড শান্তি দিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক)
জীবনানন্দ চরিত্রটি ভীতু, হতাশাগ্রস্থ, অতিমাত্রায় নারীপ্রেমিক যিনি নারীকেই শান্তি-স্বরূপা বলে মনে করেন, ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি তাকে কোন শান্তি দিতে পারে না।
বনলতা সেন কবিতায় ধূসর জগত, অন্ধকার বিদিশার নিশা, থাকে শুধু অন্ধকার– এসব বর্ণনা থেকে এটুকু বলতে পারি এটি একটি বিবর্ণ বর্ণের কবিতা।
No comments: