যারা এখনো শুধুই বন্ধু, বন্ধুর চেয়ে বেশী হয়েও অন্ধ, কিংবা জানালার একটা পাল্লা বন্ধ, একটু ভাল আর একটু মন্দ

তাদের জন্যেই কিছু এবড়ো খেবড়ো ছন্দ, তাদের জন্য কবিতা-গল্প, অল্প স্বল্প প্রেম, আড্ডা, হঠাৎ মেঘ এবং বৃষ্টি।

আবার মহালয়া

আজ মহালয়া রোজকার মত ভোরবেলা ওঠা  বা মহালয়া শোনার কোন ব্যাঘাত ঘটালাম না  পার্থক্য এই যে রেডিওর বদলে ল্যাপটপ পারিপার্শ্বিকের সাথে বদলাতে হয় সবকিছু তাই বদলাই নিজেকে একটু একটু করে পালটে যাই রোজকার তাড়ায়

আমাদের বাড়িতে দাদুর একটা পুরোনো বড় রেডিও ছিল কাঠের, বেশ বড় সড় তাতে রবিবারের আসর, বা অনুরোধের আসর খুব কম শুনেছি আমি কারণ, আমার সিনেমার প্রতি যতটা আকর্ষণ ছিল, গান বা মিউজিকের প্রতি ততটা নয় তাই রেডিওতে রোববারের দুপুরের নাটক বাজতে শুনেছি অনেকদিন ঘুম ঘোরে

মহালয়ার ভোরগুলো থেকে একটু আলাদা হতো পুজোর গন্ধ নিয়ে আসা এই মহালয়া দাদুর রেডিওটা বেজে উঠতো চারটের একটু আগেই নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধরতে হতো মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকত মহালয়া শুনব আগের রাতে বার বার মনে করিয়ে শুয়েছি যাতে মা ডেকে দেয় চোখ রগড়ে উঠে বসি পাশের ঘরে তখন বেজে উঠেছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের দৈবস্বর গোটা বাড়িটা এই কাক না ডাকা ভোরে জেগে উঠেছে বাবা সোফায় বসে মা আমাকে মুখ ধুইয়ে চলে গেছে চায়ের ব্যবস্থা করতে ছোট বোন রেডিওর সামনে মনের মধ্যে খবর হয়ে গেল পুজো আসছে বাইরে হাল্কা শিউলির গন্ধ, ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে ভেসে আসে 'বাজল তোমার আলোর বেণূ', পাড়ার আরো অন্য বাড়িতে রেডিও চলছে কুশলদের বাড়ীতে মাইক বাজতো কমলেশ কাকু প্রতিবার চালাতো  গোটা পাড়াটার মধ্যে প্রাণ জেগে উঠতো বড়মা এসে মাকে হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, মৈত্রেয়ী শুনছো তো? মা বলে, হ্যাঁ কি শুনছ, কেউ বলে না, কেউ বলে দেয় না সবাই শুনছে আমি শুনছি, বাবা শুনছে, ছোট বোন শুনছে, মা চা করতে করতে শুনছে প্রতিবার শুনে শুনে গানগুলোর সব শব্দ মনে থেকে যাওয়া সত্ত্বেও সবাই সমান উৎকর্ণ কখন শোনা যাবে হেমন্তর ঐশ্বরিক কন্ঠে, শুভ্র শঙ্খরবে বা দ্বিজেনের জাগো জাগো দুর্গা বলে কল্যানীকে আবাহন দেবীপক্ষের শুরু হয়ে যায় আকাশে বাতাসে, দিকে দিগন্তরে সকল লোকে কালো আকাশের বুক চিরে আলো দেখা যায় পূব আকাশের কোলে লালচে ছাপ পড়ে সূর্য ওঠার দেরি আছে এটা তার আগের আলো সে যে আসছে সেটা ঘরে ঘরে জানান দেওয়ার আলো বাড়ির সামনে বাবার করা ছোট্ট বাগানের ঘাসগুলো ভিজে থাকে শিশির জলে শিশির ভেজা ঘাস, মাটি মিশিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ উঠতো সেটাও এইদিন পাওয়া যেত আমরা সবাই হাঁটতে বেড়াতাম মহালয়ার দিন এটা আমাদের ওখানে একটা রীতি ছিল মহালয়ার দিন যে লোক সকাল টায় ওঠে সেও ভোরবেলা হাঁটতে বেড়াতো বেলা বাড়লে রোদের সাথে সেসব কোথায় পালিয়ে যায়, অন্যদিন দেখিনি কখনো


এরকম হারিয়ে ফেলা মহালয়াগুলো আর ফিরে আসেনা কেন আসেনা? আমরা বড় হয়ে গেছি বলে? এই মাটিমাখা সম্পর্কগুলো, এই আকাশের গন্ধ মাখা দৈব ভোর গুলো চলে যাবে আমাদের কাছ থেকে? বড় হওয়াটা কি দোষের? আমারও এই মহালয়ার দিন কেমন যেন মায়ের জন্য খুব মন খারাপ করে এই লেখাটা লিখতে লিখতেও গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে উঠছে আবার একটা মহালয়ার ভোর কেটে গেল আমার মায়ের বাড়ির রেডিওটা খারাপ হয়ে গেছে বেশ কয়েকবছর তাই হয়তো এখন আর বাজে না এপাশ ওপাশ থেকে ভেসে আসা টুকরো মহালয়া নিয়েই হয়তো মায়ের এবছরের মহালয়া আমাদের বাড়ীর ছোট ব্যাল্কনিতে বসে পূব আকাশের আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে আসা শুকতারাটার দিকে তাকিয়ে মা হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে সেই ছোটবেলার দিনগুলোর মধ্যে আমরা সবাই শুনতে থাকি মন্ত্রের মত, যা পুরোনো হয়না, কি শুনছি কেউ প্রশ্ন করেনা মা দুর্গার আবাহন করে, ডেকে আনে মনের মধ্যে স্মৃতির ভীড় কিছুটা গভীর চোখের জল মাখা কোন হারানো কথা মিশে মিলে যায় ঝরে পড়ে থাকা শিশির ভেজা শিউলিগুলোর গন্ধের সাথে শাঁখ বাজতে থাকে, উলু বাজে, আকাশের লাল ফিকে হয়ে আসে দিন গুনতে থাকি আমরা সবাই, কবে বাড়ি ফিরব মায়ের কাছে, কবে মা আসবে আমাদের কাছে

No comments: