মন খারাপ থেকে মুড অফ। এই মন খারাপগুলো ঠিক যে কোনো সঠিক কারণ মেনে হয়,
তা নয়। এর কোনও ব্যাকরণ খুঁজে বের করাও মুশকিল। শীতকালে
যেমন মাঝে মাঝে কোন এক দলছুট মেঘ এসে বাসা বাঁধে আকাশের কোণে,
এই মন খারাপ গুলোও ঠিক তেমনি। রোজকার হাজার কাজের ফাঁকেও
ঠিক এসে ছুঁয়ে যায় থেকে থেকে।
মনখারাপ করাটা আমার কাছে বেশ একটা রোজকার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভরা বিকেলে
সাঁতরে চলেছি এক সমুদ্র মনখারাপ, আবার মাঝরাতে না জানি কিসের জন্যে মনটা হুহু করে ঘুম
ভাঙ্গিয়ে দিয়ে যাওয়া মন-খারাপ, কখনও বা রবীন্দ্রনাথের কোন এক গানের গভীরে ঢুকে তার মানে
নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে ফেলে মনখারাপ। তাই হঠাৎ সাধ জাগল মন খারাপ নিয়ে কিছু
মনের কথা লিখি।
অনেক পিছনে ফিরে তাকালে সেই স্কুলের কথাগুলো মনে পড়ে। খুব ছোটবেলায় মন খারাপ
জিনিস-টা কোন মানুষেরই থাকে না। আসলে মন জিনিসটা বয়সের সাথে সাথে যত জটিল হতে থাকে,
ততই বেড়িয়ে পড়তে থাকে এর সাদা-কালো । পারিপার্শ্বিকের ছোঁয়ায় কখনও ভালো হয়ে যাওয়া মন, কখনও বা খারাপের দিকে চলা। ছোটবেলায় স্কুলে ফার্স্টবেঞ্চে
না জায়গা পেলে খুব মন খারাপ হত। বাড়ি এসে মুখ ভার। বাবাকে বলতাম,
কাল থেকে আরোও আগে নিয়ে যাবে তুমি। সেই একদিনের কথা বেশ মনে
পড়ে। ক্লাশ ওয়ান বা টু। মা সেবার একটা নতুন মিল্টনের জলের বোতল কিনে দিয়েছিল।
সেদিন ফার্স্টবেঞ্চে যায়গা থাকা সত্ত্বেও অভ্র এর জন্য জায়গা রাখবে বলে সুদীপ্ত
বসতে দিচ্ছিল না। আমি বরাবরের প্রতিবাদী। জোর করে বসবই। সুদীপ্ত ধাক্কা মেরে আমার
বোতলটা ফেলে দেয়। আর নতুন বোতলের ঢাকনাটা ভেঙে চৌচির। সেবার মনখারাপটা বেশ অনেকদিন
ছিল। বাবা ফেভিকল দিয়ে জুড়ে দেওয়া সত্ত্বেও ওই দাগটা রয়ে গেছিল।
ভালো জামা-কাপড় বা খেলনা মিয়ে মন খারাপ আমার কখনও হয়েছে বলে মনে পড়েনা। শুধু
এক বন্ধুর কাছে রিমোট-কন্ট্রোলড্ গাড়ি দেখে খুব শখ হয়েছিল। আমার সেটা কেনা হয়নি।
বদলে বাবা একটা লাল-সাদা রঙের গ্লাইডার কিনে দিয়েছিল। সেই মনখারাপটা অনেকটাই উড়িয়ে
নিয়ে গেছিল ওই আকাশে ভেসে বেড়ানো আমার লাল-সাদা গ্লাইডার।
আর একটু বড় হয়ে যখন আর. কে. আই. এ পড়ি (আমার দ্বিতীয় স্কুল),
এই মন খারাপের ধরনটা অনেকটাই পালটে যেতে লাগলো। প্রথম প্রথম
টিফিনের সময় খেলতে না পারলে মন খারাপ হত খুব। তারপর কম্পিটিশনে প্রাইজ না পেলে ভীড়
করে আস্ত এক গাদা মন খারাপ। আর পুজোর সময় ক্যাপ ফাটানো বন্দুক। ক্লাশ এইট নাইনে
যখন ‘বড়’ হতে শুরু করলাম, এই মনখারাপ গুলো কোথায় যেন আসতে আসতে মিলিয়ে যেতে লাগল
হারানো ছেলেবেলাটার সাথে। ‘প্রেম’ এর মত ‘নিষিদ্ধ’ শব্দ ভীড় করতে থাকে চারপাশে। বায়োলজির বইয়ের বিশেষ চ্যাপটার
ঘিরে অদম্য কৌতূহল। এই না-বড়-না-ছোট বয়সে মনখারাপটা রূপ পালটে ফেলল অনেকখানি। না
বুঝতে পারা হঠাৎ করে মনখারাপের শুরু। হাতে পেয়ে শেষের কবিতা পরে একদিন খুব মন
খারাপ। কার জন্য জানিনা। এরপর কত রাত গেছে ‘মোর লাগি করিওনা শোক’ আবৃত্তি করে।
ক্লাশের গন্ডি পার হয়ে কলেজ। ছেলেমানুষের তকমা ছেড়ে,
বড় হয়ে চলা। প্রেমে পড়ে বলতে না পারার জন্য মন খারাপ ভীড়
করতে শুরু করে। আবার যেদিন বলে ফেলা গেল সব কথা, আমার জমিয়ে রাখা সব সুখ দুঃখ তুলে দেওয়া গেল,
তার হাতে, সে রাতে বিফলতার শোকে বালিশ ভিজিয়ে চাপা পড়ে থাকা এক পাহাড়
মনখারাপের তলায়। এই মন খারাপের দিনে লিখে ফেলা ছেলেমানুষি কত কবিতা এসেছে। মন
খারাপের রাতে লিখে ফেলেছি অনেক গল্পকথা।
এই প্রেম হারানোর মন খারাপের বেলা আর আসেনা। প্রেমের দেখা পেয়ে তাতেই গা
ভাসিয়েছি। তাই এখনের মন খারাপ গুলো আবার পালটে ফেলেছে নিজেদের। এখন সেই আচমকা
মেঘের মত মাঝে মাঝে মন ভার হয়ে আসে। ঘরে বসে একের পর এক শুনে চলা গান টেনে নিয়ে
যেতে থাকে কোন এক অদ্ভুত মন খারাপের দেশে। সে এক অবর্ণনীয় মন খারাপের অনুভুতি।
মাঝে মাঝে ফেস্বুকের পাতায় স্ট্যাটাসে আজেবাজে লিখি। সবাই ভাবে এ কি পাগলামি!
আসলে সেই মন খারাপের দেশে গিয়ে খুব ইচ্ছে করে কারোর সাথে বলে ফেলি এই সমস্ত মন
খারাপের ধারাপাত । কিন্তু ভাষায় পড়ে টান। মনে হয়,
‘বলব যা মোর চিত্তে লাগে,
নাই বা তাহার অর্থ হোক, নাই বা বুঝুক বেবাক লোক’।
No comments: