যারা এখনো শুধুই বন্ধু, বন্ধুর চেয়ে বেশী হয়েও অন্ধ, কিংবা জানালার একটা পাল্লা বন্ধ, একটু ভাল আর একটু মন্দ

তাদের জন্যেই কিছু এবড়ো খেবড়ো ছন্দ, তাদের জন্য কবিতা-গল্প, অল্প স্বল্প প্রেম, আড্ডা, হঠাৎ মেঘ এবং বৃষ্টি।

একটি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি দূষণ

“পরবর্তী স্টেশন নেতাজী। প্লাটফর্ম ডানদিকে”
"The next station is Netaji. Platform is on right side". 

তখনও ট্রেন ঢোকেনি। আমার চোখ আটকে লাইনের প্রচণ্ড বিদ্যুৎ পরিবাহী শোয়ানো বিমগুলোর দিকে। বাতানুকূল মেট্রোর বড় জানলার বাইরে থেকে পরিপাটি সফিসটিকেটেড মানুষগুলোকে দেখতে বেশ ভালো লাগে। দরজা খুলতেই ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন নেমে এলেন। মুখোমুখি হয়েও ধাক্কা লাগলো না। আর নিয়মমাফিক ভেতরে ঢোকার আগে দরজার চ্যানেল বরাবর পা টা ফেলে দিলাম যাতে দরজা বন্ধ হতে কিছুক্ষন সময় নেয়। এটা আমার বহুদিনের অভ্যাস। এরকম করে বহুদিন বহু মানুষকে সাহায্য করেছি। আজও তাই হল। বুঝলাম পেছন থেকে কে ছুটে এসে অবশেষে ধরতে পেরেছে। মুহূর্তের মধ্যে দরজাটা দুপাশ থেকে বন্ধ হল। একটা দামাল নিঃশ্বাস ক্লান্ত স্বরে। শুধু একটা কথাই কানে গেল। “থ্যাংকস”।

মাঝে চলে গেছে একটা ষ্টেশন, খেয়াল পড়েনি।

“পরবর্তী ষ্টেশন যতিন দাস পার্ক। প্ল্যাটফর্ম বাদিকে। The next station is Jatin Das ParkPlatform is on left side".

দরজার ঈষৎ কালো কাচে প্রতিবিম্ব দেখলাম আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির, যে কিছুক্ষণ আগে থ্যাংকস বলল। লাল রঙের ওপর সবুজ রঙ্গের গোল প্রিন্টার সালোয়ার। খোলা ছুল, চোখে কাজল, গায়ে শহুরে পার্লারের আভিজাত্য আর ঠোঁটে গ্লসি লিপস্টিক এর আবরণ। হাতে রঙ্গিন কাঠের চুরির শেষ এবং শুরুটা কালো।

আমার এক কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ টা আর অন্য কাঁধে এই অপরূপাকে জায়গা করে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব।
যতবার কাচের দিকে তাকাই ততবার চোখে চোখ পড়ে। ততবারই মাথা নিচু। আমার মেসেজ টোন বেজে ওঠে - “আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে”

আর যতবার ই আমার মেসেজ টোন বেজে ওঠে ততবার মুখে এক অদ্ভুত বিরক্তি প্রকাশ পায় তার। আমি জায়গা করে দেই ভেতরে প্রবেশের। ঠিক বা হাতেই শারীরিক প্রতিবন্ধীর সিট। মেয়েটি বসলো না। পেছন থেকে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। আমার চারপাশটা তখন বিদেশী পারফিউমের গন্ধে মোঃ মোঃ।  গোলাপের পাপড়ি মুঠো করে ছিঁড়ে দু হাতের মুঠো তে ঘষলে যে বন্য গন্ধে চারিদিক ভাসে মেয়েটির গায়েও সেই গন্ধ। আমার বাঁ হাত টা পকেটে আর ডান হাতে ব্যাগটা নামিয়ে পায়ের মাঝে রেখে দাঁড়ালাম। তখন সবে নেতাজী ভবন। জলন্ধরে হঠাৎ পায়ে ক্রাম্প হয়েছিল। তাই আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। একটু বসতে ইচ্ছা করছিল। ভাবতে না ভাবতেই একজন উঠে গেলেন। আমার পাশে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি।

মাথা ঝুকিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি ব্যাগটা এক হাতে চেপে ধরে তার দিকে তাকালাম এবং খোলা হাতে “আপ কে লিয়ে” ভঙ্গিতে সিট টা ছেড়ে দিলাম। মেয়েটি বসার আগে এক ঝলক তাকালো, হাসলোআর কিছুক্ষণ যেতেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আরও একটু পরিপাটি করে নিল। আমার চোখ বাইরে স্থির। অন্যদিকে মেট্রো গতি নিয়ে ছুটে চলে আপন খেয়ালে। কিছুক্ষণ পর এক ঝলক নামিয়ে দেখি বুকের ওড়নাটা উঠে এসেছে অনেক উপরে। তেরচা গলার সালোয়ারে ঈষৎ বুকের পাতায় যেন এক স্নিগ্ধ জলপ্রপাত। এত দামী সালোয়ার পিস এর অর্ডারে দর্জির যত রাগ যেন বুকের কাটিং এ। যথারীতি একটু ঝুকে বসলে যা হয়। আমি বাধ্য হয়েই বললাম “হেলান দিয়ে বসলে ভালো হয়না”। মেয়েটি বুঝতে পেরে মাথা নিচু করলো, খোলা চুলে চাপা দিল পুরুষের যাবতীয় দর্শন। রক্ষা পেল আরও এক নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি দূষণ। 

No comments: